লেখাপড়া করতে চাওয়াই কাল হলো তাঁর। কেটে নেওয়া হলো তাঁর ডান হাতের চারটি আঙুল। স্বামীর অসম্মতিতে কলেজে ভর্তি হওয়ায় গৃহবধূ হাওয়া আক্তার ওরফে জুঁইকে এ শাস্তি দেওয়া হয়।
ঘটনাটি ঘটেছে ৪ ডিসেম্বর। ভুক্তভোগী গৃহবধূ নরসিংদী সরকারি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। নরসিংদী সদর উপজেলা মোড়সংলগ্ন ভেলানগর এলাকায় তাঁর বাবার বাড়ি।
হাওয়ার পরিবার সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের ৩০ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার নূরজাহানপুর গ্রামের রফিকুল ইসলামের সঙ্গে হাওয়ার বিয়ে হয়। লেখাপড়ার প্রতি হাওয়ার প্রবল আগ্রহ থাকলেও তাঁর স্বামী জানিয়ে দেন, আর লেখাপড়া করা যাবে না। এরই মধ্যে হাওয়ার এসএসসি পরীক্ষার ফল বের হয় এবং তিনি ‘এ গ্রেড’ পান। ২০০৮ সালের শেষের দিকে রফিক হাওয়াকে তাঁর বাবার বাড়ি রেখে দুবাই চলে যান।
হাওয়ার বাবা ইউনুছ মিয়া একজন তাঁতশ্রমিক। লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকায় জামাইকে না জানিয়েই তিনি মেয়েকে নরসিংদী সরকারি কলেজে ভর্তি করেন। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনী পরীক্ষায় ভালো ফল করায় আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন হাওয়া। কিন্তু কোনোভাবে হাওয়ার লেখাপড়ার খবর জানতে পেরে রফিক খেপে যান। হাওয়ার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি।
রফিক গত ২৭ নভেম্বর দুবাই থেকে হাওয়াকে ফোন করে জানান, তিনি তাঁর জন্য মুঠোফোনের একটি সেট, কিছু স্বর্ণালংকার ও কসমেটিকস রফিকের বোনের বাসায় পাঠিয়েছেন। এগুলো তিনি তাঁর বোন নাঈমা বেগমের ঢাকার বাসা থেকে নিয়ে যেতে বলেন। পরে হাওয়া ১ ডিসেম্বর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার জিয়া কলোনিতে তাঁর ননদের বাসায় যান।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে হাওয়া গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘৪ ডিসেম্বর সকালে ঘুম থেকে জেগে আমার বিছানার সামনে দেখি, রফিক দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কখন এলে? উত্তরে রফিক বলে, এই তো কিছুক্ষণ হলো দুবাই থেকে এলাম। তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে জানাইনি। এ সময় রফিক রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। সে আমাকে বলে, আমি নিষেধ করা সত্ত্বেও তুমি তাহলে ঠিকই পরীক্ষা দিয়েছ, তোমার জন্য একটা পুরস্কার আছে। চোখটা বন্ধ করো। এ সময় আচমকা সে ওড়না দিয়ে আমার দুই চোখ টাইট করে বেঁধে ফেলে। মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে বলে, একদম চুপ। এরপর আমার ডান হাত টেনে ধারালো চাপাতি দিয়ে আঙুলে কোপ দেয়। তারপর আমি আর কিছুই বলতে পারব না।’
হাওয়া জানান, জ্ঞান ফিরলে তিনি নিজেকে হাসপাতালে দেখতে পান। এ সময় তাঁর স্বামী ও ননদেরা তাঁকে প্রকৃত ঘটনা কাউকে না বলে দুর্ঘটনা হয়েছে বলে বলতে বলেন। কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসক সত্যি না বললে চিকিৎসা করবেন না বললে তিনি তাঁকে সব খুলে বলেন। পরে ওই চিকিৎসক বিষয়টি মুঠোফোনে তাঁর বাবাকে জানান। এরপর তাঁর বাবা ঢাকায় এসে তাঁকে উত্তরার বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসা শেষে ৬ ডিসেম্বর তাঁরা নরসিংদী ফিরে আসেন।
যোগাযোগ করা হলে হাওয়ার বাবা ইউনুছ মিয়া কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়ের একটাই অপরাধ, সে কলেজে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করছে। আমার জন্যই ওর এমনটি হয়েছে। আমি কেন মেয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে তাকে কলেজে ভর্তি করলাম। এখন তার হাতও গেল, স্বপ্নেরও মৃত্যু হলো।’
ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন আহমেদ জানান, ঘটনার পরের দিন ৫ ডিসেম্বর রফিকুল ইসলামকে তাঁর বোনের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় তাঁর কাছ থেকে একটি চাপাতি ও চারটি আঙুল উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় হাওয়ার বাবা বাদী হয়ে ৬ ডিসেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে থানায় মামলা করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ক্যান্টনমেন্ট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) এ আর এম আল মামুন জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রফিক তাঁর অপরাধের কথা স্বীকার করেছেন। তবে এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রফিক বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।
সংগ্রহ : প্রথম আলো
No comments:
Post a Comment