আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে আমরা ব্যবহার করতে শিখেছি স্মার্ট সব প্রযুক্তি। স্মার্ট মোবাইল ফোন, ট্যাব ও ল্যাপটপের প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে করেছে অনেক সহজ। আর এই প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতাই খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষার্থীদের ইউনিভার্সাল স্মার্ট এনার্জি মিটার উদ্ভাবনে উৎসাহিত করেছে।
২০১১ সালে কুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাসুম বিল্লাহ ও লাবিব এবং যন্ত্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জিএম সুলতান মাহমুদ রানা প্রথম ইউনিভার্সাল স্মার্ট এনার্জি মিটার উদ্ভাবন করার কাজ শুরু করেন। প্রায় দুই বছর ধরে এই মিটার উদ্ভাবনের চেষ্টায় সফলতার মুখ দেখেন তারা।
তাদের এ মিটার উদ্ভাবনের ফলে মোবাইল ফোনের এসএমএসের মাধ্যমেই বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। দরকার হবে না আইপিএস, জেনারেটর ও ব্যাটারির।
মিটারটি ব্যবহার করলে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সুবিধা পাবেন গ্রাহকরা। দেশের আবাসিক অঞ্চলের জন্য মিটারটি অভাবনীয় সাফল্য ধরে রাখবে বলে দাবি উদ্ভাবক টিমের।
মিটারটির মাধ্যমে ডিস্ট্রিবিউশনকারী প্রতিষ্ঠান প্রিপেইড ও পোস্টপেইড দুই ধরনের সবিধাই পাবে। ভুতুড়ে বিল থেকে মুক্তি পাবেন গ্রাহকরা। এছাড়া মিটারটির ব্যবহারে রয়েছে নানাবিধ সুবিধা।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইউনিভার্সাল স্মার্ট এনার্জি মিটার উদ্ভাবন প্রসঙ্গে উদ্ভাবন টিমের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।
এ সময় তারা জানান, এই ব্যতিক্রমধর্মী মিটারের চিন্তা লাবিব ও মাসুম বিল্লাহর মাথায় প্রথম আসে। পরবর্তীতে প্রোগ্রামিং ও অন্যান্য টেকনিক্যাল কাজে সহযোগিতার জন্য রানাও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এতে সার্বিক সহযোগিতা করেন তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. মো. রফিকুল ইসলাম।
তারা দাবি করে বলেন, ‘এই মিটারের মাধ্যমে দেশের আবাসিক এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া রোধ করা যাবে। গ্রাহকরা ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুতের সুবিধা পাবেন। সরকার বাণিজ্যিকভাবে মিটারটির বাস্তবায়ন ঘটালে দেশের বিদ্যুতের সমস্যা দূরসহ বিদ্যুৎখাতে বছরে প্রায় পাঁচশ কোটি টাকা নন-টেকনিক্যাল ক্ষতি দূর করা সম্ভব হবে।’
মিটার প্রসঙ্গে তারা বলেন, ‘এই মিটারে তিনটি প্রধান ইউনিট আছে- একটা পাওয়ার পরিমাপক ইউনিট, একটা ডিসপ্লে ইউনিট, আরেকটা রিমোট কম্যুনিকেশন ইউনিট। পরিমাপক ইউনিট মেইন লাইন থেকে সিগন্যাল নিয়ে ভোল্টেজ, কারেন্ট, পাওয়ার ফ্যাক্টর ও ব্যবহৃত বিদ্যুৎ কিলোওয়াট-আওয়ার পরিমাপ করে।
ডিসপ্লে ইউনিট কিলোওয়াট-আওয়ার, ব্যালান্স (টাকা), ভোল্টেজ ও পাওয়ার ফ্যাক্টর প্রদর্শনের কাজ করে এবং রিমোট কম্যুনিকেশন ইউনিটের সাহায্যে মিটারটিকে দূর থেকে কন্ট্রোল করা যায়। আর এখানে ব্যবহার করা হয়েছে, একটা জিএসএম মডিউল যার মাধ্যমে ম্যাসেজ দিয়েই যেকোনো জায়গা থেকে এই এনার্জি মিটারের নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
আমরাই প্রথমবারের মতো এই মিটারের উদ্ভাবন করেছি, যেটাতে ম্যাসেজের মাধ্যমে যেকোনো অপশন আবার কনফিগার করা যায়।’
তারা বলেন, ‘একই মিটারে প্রিপেইড ও পোস্টপেইড সুবিধাও আমাদের মিটারেই প্রথম। আর লোড ব্যবস্থাপনার ধারণাও আমরাই প্রথম দিয়েছি। ট্যারিফ প্লানের যে নতুন ধারণা আমরা দেখিয়েছি, সেটাও প্রথম। এছাড়াও থাকছে, পাওয়ার ফ্যাক্টর মনিটরিংয়ের নতুন সুবিধা।
ব্যালান্স সমন্বয়ের মতো অভিনব ব্যবস্থাও থাকছে মিটারটিতে। আর এ মিটারকে একটা কন্ট্রোল রুম থেকেই নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যা পাওয়ার সিস্টেমকে করবে স্মার্ট।’
এই মিটারের বিশেষ সুবিধা প্রসঙ্গে উদ্ভাবকরা বলেন, ‘ধরুন গ্রাহক প্রিপেইড মিটার কিনে নিয়ে গেছেন। কিন্তু, পরে তার মনে হলো পোস্টপেইড মিটার হলে ভালো হতো, তখন তিনি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিকে শুধু একটা ম্যাসেজে দিয়েই মিটারটি প্রিপেইড থেকে পোস্টপেইড অথবা পোস্টপেইড থেকে প্রিপেইড করে নিতে পারবেন।
এছাড়া ধরুন, গ্রাহক তিন হাজার ওয়াটের সংযোগ নিয়েছেন। পরে দেখলেন তার বিদ্যুৎ ব্যবহার বেড়েছে। তার চার হাজার ওয়াট দরকার। তখন তিনি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিতে শুধুমাত্র একটা ম্যাসেজে পাঠিয়েই অনুমোদিত বিদ্যুৎ ব্যবহারের সীমা তিন হাজার ওয়াট থেকে পরিবর্তন করে চার হাজার ওয়াট করে দিতে পারবেন।’
তারা বলেন, ‘গ্রাহক এই সীমা অতিক্রম করতে পারবেন না। যখনই বিদ্যুৎ ব্যবহার ওই সীমানা অতিক্রম করবে, তখনই তার বাসার বিদ্যুৎ সংযোগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং এক মিনিট পরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবার সংযোগ দেওয়া হবে। যদি তিনি অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার না কমান, তাহলে আবারও অফ হয়ে যাবে ও এক মিনিট পরে আবার অন হবে। এই রকম তিনবার হবে এবং তারপর সম্পূর্ণভাবে অফ হয়ে যাবে ও সেই গ্রাহকের কাছে একটা ম্যাসেজে যাবে যে, ‘আপনি আপনার বিদ্যুৎ ব্যবহারের অনুমোদিত সীমা অতিক্রম করেছেন। অতিরিক্ত সংযোগ অফ করুন এবং মিটারে ‘NORMAL’ ম্যাসেজে পাঠান।’
ট্যারিফ প্ল্যান বিষয়ে তারা বলেন, ‘এটা সেই প্ল্যান যা আপনার বিদ্যুৎ বিলের হিসাব নির্ধারণ করে দেবে। প্রতি ইউনিটের দাম কত হবে, পিক-অফপিকের বিল আলাদার বিষয়টিও নির্ধারণ করে দেবে। আমাদের এনার্জি মিটারে তিন ধরনের ট্যারিফ প্ল্যান রয়েছে।
১। ব্লক রেট সিস্টেম
২। টাইম গ্রেডিং সিস্টেম
৩। একত্রিত সিস্টেম
এ রকম প্ল্যান অন্য মিটারেও থাকতে পারে। কিন্তু, আমাদের মিটারের সুবিধা হলো, ম্যাসেজের মাধ্যমে মিটারে ট্যারিফ প্ল্যান পরিবর্তন করা যাবে। শুধু একটা ম্যাসেজের মাধ্যমেই যেকোনো সংখ্যায় ভাগ করে যেকোনো ট্যারিফ প্ল্যান সেট করা যাবে।’
রিচার্জিং সিস্টেম প্রসঙ্গে তারা বলেন, ‘বিল দেওয়ার পরিবর্তে রিচার্জিং সিস্টেম বলার কারণ হলো গ্রাহক তার মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই বিল পরিশোধ করতে পারবেন। সেটা বিকাশের মাধ্যমেও হতে পারে। বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার জন্য তাকে আর ব্যাংকের লাইনে দাঁড়াতে হবে না।’
জরুরি বিদ্যুৎ প্রদান সম্পর্কে উদ্ভাবক টিম বলেন, ‘এটা আমাদের মিটারের একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন। আমাদের এই সুবিধার মাধ্যমে অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ জেনারেশনের সময় সম্পূর্ণ লোডশেডিং না করে প্রতিটা বাড়ির আংশিক লোডশেডিং করে জরুরি বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে; যার মাধ্যমে ওই সময় সবাই বাড়িতে শুধু লাইট ও ফ্যান চালাতে পারবেন। কাউকে আর আইপিএস, জেনারেটরের মতো ব্যয়বহুল ডিভাইস ব্যবহার করতে হবেনা।’
কীভাবে এটা সম্ভব, জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘এই মিটারের মাধ্যমে গ্রাহককে শুধু জরুরি বিদ্যুতের জন্য একটা অতিরিক্ত লাইন দেওয়া হবে, অনেকটা আইপিএসের লাইনের মতো। যখন কম বিদ্যুৎ তৈরি হবে, লোডশেডিংয়ের প্রয়োজন হবে, তখন শুধু ওই জরুরি লাইনেই বিদ্যুৎ থাকবে যার মাধ্যমে জরুরি লোড যেমন লাইট, ফ্যান এসব চালানো যাবে।
ওই লাইনে যত বিদ্যুতের জন্য লিমিট দিয়ে অন রাখা হবে তার থেকে বেশি নিতে পারবেনা। এ জন্য অন্য কোনো অতিরিক্ত লোড লাগালে বাসার সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ স্বয়ংক্রিয়ভাবে অফ হয়ে যাবে।
এ ছাড়া কন্ট্রোল রুমের পাশাপাশি আমাদের এই মিটারের স্ট্যাটাস গ্রাহকও যেকোনো সময় দেখতে পারবেন। দূর থেকে গ্রাহক তার নিজের বাড়ির পাওয়ার অফ করে রাখতে পারবেন। মিটারে কেউ কোনো কারসাজি করতে চাইলে কন্ট্রোল রুমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সতর্কবার্তা চলে যাবে। এছাড়া ওভারলোড, ওভার ভোল্টাজে, আন্ডার ভোল্টাজে এবং সেলফ প্রটেকশন তো থাকছেই। আরো আছে বাইপাস সতর্কীকরণ ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে এই স্মার্ট এনার্জি মিটার পাওয়ার সিস্টেমে নুতন এক মাত্রা যোগ করবে।’
উদ্ভাবিত এ মিটারের ব্যাপারে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. মো. রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘এক মিটারে এত সুবিধা বিশ্বের আর কোথাও উদ্ভাবিত হয়নি।’
তিনি দাবি করেন, ‘কুয়েটের শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবিত ইউনিভার্সাল স্মার্ট এনার্জি মিটারে প্রথম এক সঙ্গে এত সুবিধা পাওয়া যাবে।’
তিনি জানান, বাণিজ্যিকভাবে সরকার মিটারটির বাস্তবায়ন ঘটালে দেশের বিদ্যুতের সমস্যা দূরসহ বিদ্যুৎ খাতে বছরে প্রায় পাঁচশ কোটি টাকা টেকনিক্যাল ও নন-টেকনিক্যাল ক্ষতি দূর করা সম্ভব হবে।
সূত্র: http://www.banglanews24.com/
No comments:
Post a Comment