Sunday, August 14, 2011

তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ ৫ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত

‘মুক্তির গান’, ‘মাটির ময়না’, ‘রানওয়ে’খ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। গতকাল দুপুরে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুড়ি এলাকায় মাইক্রোবাস ও বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে তাদের মৃত্যু
হয়েছে। নিহত অন্যরা হলেন এফডিসির প্রোডাকশন সহকারী ওয়াসিম, এফডিসির চলচ্চিত্র কর্মী ঘরনির্মাতা জামাল ও গাড়িচালক মোস্তাফিজুর রহমান। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ঢালি আল মামুন ও তার স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম জলি। তাদের প্রথমে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে ও পরে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ ৫ জনের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া গভীর শোক জানিয়েছেন।
ঘিওর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রইসউদ্দিন জানান, শনিবার দুপুরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মানিকগঞ্জের ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে ঘিওর উপজেলার জোঁকা নামক স্থানে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জের জোঁকা নামক স্থানে পাটুরিয়াগামী দূরপাল্লার কোচ চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের (ঢাকা মেট্রো ব-১৪-৪২৮৮) সঙ্গে তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরকে বহনকারী ঢাকা অভিমুখী মাইক্রোবাসের (ঢাকা মেট্রো চ-১৩-০৩০২) মুখোমুখি সংষর্ষ হয়। এতে মাইক্রোবাসটি দুমড়ে-মুচড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে
যায়। কোচটির সম্মুখভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘটনাস্থলেই তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ ৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনার পর মানিকগঞ্জের পুলিশ ও ঘিওরের ফায়ার সার্ভিস আহতদের উদ্ধার করে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেয়।
দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ওই স্থানের সড়কে একটু মোড় ছিল। মাইক্রোবাসটি ডানদিকে বেশি চেপে যাচ্ছিল। এ সময় বিপরীত থেকে আসা বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মাইক্রোবাসটি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক শিবানী ভট্টাচার্য, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আলী মিয়া আহত ও নিহতদের দেখতে মানিকগঞ্জ হাসপাতলে যান। এ সময় মানিকগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যক্তি সাধারণ মানুষও হতাহতদের দেখতে হাসপাতালে ভিড় করেন।
দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িতে থাকা বেঁচে যাওয়া যাত্রী তারেক মাসুদের সহকারী মনিশ রফিক একটি মাইক্রোবাসে করে গতকাল ভোর ৬টার দিকে তারেক মাসুদ, তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী (সিইও) মিশুক মুনীর, শিল্পী ঢালী আল-মামুন ও চিত্রশিল্পী দিলারা বেগম জলিসহ ৯ জন মানিকগঞ্জে যান। তারা শিবালয় উপজেলার শালজানা গ্রামের ইছামতি নদীর পারে ‘কাগজের ফুল’ ছবির শুটিং স্পট দেখতে যান। স্পট দেখা শেষে ১২টা ২০ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন তারা। তাদের বহনকারী দ্রুতগামী গাড়িটি ঘিওরের বানিয়াজুড়ি মোড়ে আসামাত্রই দুর্ঘটনায় পড়ে। দুর্ঘটনায় মনিশ রফিক নিজেও আহত হন।
মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন ডাক্তার সিদ্ধেশ্বর মজুমদার জানান, চলচ্চিত্রকার মোর্শেদুল ইসলামের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিহতদের লাশগুলো ময়নাতদন্ত ছাড়াই একটি অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। রাত ৮টার দিকে লাশগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে নেয়া হয়েছে। এখান থেকে লাশগুলো যার যার বাড়িতে পাঠানো হবে।
বানিয়াজুড়ির জোঁকা মোড়ে গিয়ে দেখা গেছে হাজারও মানুষের ভিড়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এক ব্যক্তি জানান, তার বাড়ির পাশের মোড়ে হঠাত্ একটি শব্দ হয়। তিনি এসে দেখেন রাস্তার ওপরে একটি মাইক্রোবাস দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে আছে। এর সামনের সিটের দু’জন লোক মৃত ছিল। পিছনের সিটে আরও তিনজন প্রায় মারা গেছেন। তিনি বাড়ি গিয়ে মোবাইল ফোনে পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ আসার আগেই ওই তিনজনেরও মৃত্যু হয়েছে। আহতদের উদ্ধার করেন তারা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বানিয়াজুরির এ জোঁকা মোড়টি একটি মৃত্যুকূপ। এখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। ঘিওর থানা পুলিশ জানায়, তারা ঘাতক বাসটি আটক করেছে। তবে চালক পালিয়ে গেছে।
মিশুক মুনীরের ভাই আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার এদেশীয় মুখপাত্র আসিফ মুনীর সাংবাদিকদের বলেন, প্রথমে মোবাইল ফোনে ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শোনামাত্রই আত্মীয়-স্বজনরা দুর্ঘটনাস্থলের দিকে ছুটে যান।
ঢাকা মেডিকেলে লাশ : তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ ৫ জনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয় রাত ৮টা নাগাদ। সেখানে গোসল ও আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষে লাশগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারেক মাসুদের লাশ নেয়া হয়েছে তার মনিপুরের বাসায়। আর মিশুক মুনীরের লাশ তার বনানীর বাসায় নিয়ে সেখান থেকে স্কয়ার হাসপাতালের মরচ্যুয়ারিতে রাখা হয়। তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের লাশ ঢাকায় পৌঁছানোর খবরে সাংবাদিক, চলচ্চিত্রসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জড়ো হতে থাকেন। তাদের লাশ পৌঁছার পর সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। ঘটনাস্থলে যান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকাসহ অনেকে। মির্জা ফখরুল জানান, প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। আমরা আমাদের সড়কগুলোতে আর কতকাল এভাবে দেশের গুণী মানুষদের হারাতে থাকব।
আহতরা আশঙ্কামুক্ত : স্কয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন মানিকগঞ্জের ঘিওরে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত চারজনের মধ্যে ঢালী আল মামুনের অবস্থা খুব খারাপ। তার বক্ষের ১২টি হাড়ের মধ্যে আটটি ভেঙে গেছে। তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। ক্যাথরিন মাসুদের মাথায় আঘাত লাগলেও ব্রেনে আঘাত লাগেনি। তিনি শঙ্কামুক্ত। তাকে নিউরো আইসিইউতে রাখা হয়েছে। এছাড়া দিলারা বেগম জলি এবং সাইদুল ইসলামের হাতে আঘাত লেগেছে। তাদের হাতের হাড় ভেঙে গেছে। তবে তারা শঙ্কামুক্ত। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মজিবুর রহমান জানান, মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ক্যাথরিন মাসুদ, ঢালী আল মামুন ও দিলারা বেগম জলি শঙ্কামুক্ত রয়েছে। গতকাল বিকালে স্কয়ার হাসপাতালে তাদের খোঁজ-খবর নেয়ার পর উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি একথা জানান।
খ্যাতিমান তারেক মাসুদ : তারেক মাসুদ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’-এর পরিচালক। এছাড়াও তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো ‘মাটির ময়না’। তারেক মাসুদ নামটির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল অনেক সম্ভাবনা আর জাতীয়-আন্তর্জাতিক খ্যাতি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ চলচ্চিত্রকারের অনেক চলচ্চিত্র জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করেছে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৪ বছর।
১৯৫৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ফরিদপুরের ভাঙ্গায় জন্ম নেয়া তারেক মাসুদ বাল্যকালে ছিলেন মাদরাসার ছাত্র। সপ্তাহখানেক আগে তারেক মাসুদের বাবা মারা গেছেন। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তারেক ছিলেন সবার বড়। তারেক মাসুদের ছেলের নাম বিংহাম পুত্রা মাসুদ নিশাদ।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মাদরাসা শিক্ষার সমাপ্তি হয় তার। যুদ্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে তারেক মাসুদ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন।
প্রখ্যাত শিল্পী এস এম সুলতানের জীবনের ওপর ১৯৮২ সালের দিকে তারেক মাসুদ প্রথম তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। এরপর থেকেই বেশ কিছু তথ্যচিত্র, অ্যানিমেশন ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি।
২০০২ সালে মুক্তি পায় তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’। এ চলচ্চিত্রটি কান চলচ্চিত্র উত্সবে প্রদর্শিত হয় এবং দেশ-বিদেশের বিশেষ প্রশংসা অর্জন করে। বাংলাদেশের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সংগঠন ‘শর্ট ফিল্ম ফোরাম’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তারেক মাসুদ। ১৯৮৮ সালে সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছেন ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উত্সবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে যোগ দেয়ার পাশাপাশি কয়েকটি সাময়িকী ও পত্রিকায় চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখালেখি করতেন তিনি।
তারেক মাসুদ তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদকে নিয়ে ‘অডিও ভিশন’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। চলচ্চিত্র নির্মাণ ছাড়া লোকসঙ্গীত এবং লোকধারার প্রতিও প্রবল আগ্রহ ছিল তার। তারেক মাসুদ নির্মিত চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্রগুলো হচ্ছে ‘এ কাইন্ড অব চাইল্ডহুড’, ‘সোনার বেড়ি’, ‘মাটির ময়না’, ‘নারীর কথা’, ‘মুক্তির কথা’, ‘ইন দ্য নেইম অব সেফটি’, ‘ভয়েসেস অব চিলড্রেন’, ‘মুক্তির গান’, ‘ইউনিসন’, ‘সে’, ‘আদম সুরত’, ‘অন্তর্যাত্রা’, ‘রানওয়ে’ ও ‘নরসুন্দর’।
মিশুক মুনীর : মিশুক মুনীর। পুরো নাম আশফাক মুনীর চৌধুরী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর। শহীদ বুদ্ধিজীবী নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর ছেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী, পরে শিক্ষক। পড়াতেন ইলেক্ট্রনিক জার্নালিজম সাবজেক্টটি। আশফাক মুনীর গণমাধ্যম জগতে মিশুক মুনীর নামেই বেশি পরিচিত। তবে মিশুক মুনীর মূলত পরিচিত ছিলেন একজন দক্ষ ক্যামেরাপার্সন হিসেবে। বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি চ্যানেল একুশে টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। শিক্ষকতার চেয়ে ক্যামেরা হাতে কাজ করাটাই ছিল তার বেশি পছন্দের। যখন দেশে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বিকাশ হয়নি, তখন সেই টানেই তিনি ছুটতেন দেশের বাইরে। দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি কাজ করেছেন ক্যামেরা কাঁধে। দেশে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চ্যানেলের হয়ে রিপোর্ট তৈরি করেছেন। পরে একুশে টেলিভিশন চালু হলে এ অঙ্গনে দেশের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিটি হিসেবে মিশুক মুনীরই দায়িত্ব পান সংবাদ বিভাগ পরিচালনার। নিজের হাতে গড়ে তোলেন একুশের সংবাদ টিম।
একুশে টেলিভিশনের পর প্রতিভাবান এই ক্যামেরাম্যানের ডাক পড়ে বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে। হলিউডেও ছিল তার কাজের অভিজ্ঞতা। কানাডার রিয়েল নিউজ নেটওয়ার্কের হয়ে কাজ করেছেন দীর্ঘসময়। কিন্তু বিদেশের জন্য নয়, দেশের জন্যই দেশে ব্রডকাস্ট জার্নালিজমের বিকাশেই কাজ করতে চাইতেন মিশুক মুনীর। সে কারণে দেশে ফিরে আবার দায়িত্ব নেন এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী হিসেবে। লিবিয়া যুদ্ধের খবর সংগ্রহে কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে ছুটেছেন যুদ্ধের ময়দানে ময়দানে।
স্বজনরা জানান, ক্যামেরার কাজকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন মিশুক মুনীর। এজন্যই তিনি কাজ শুরু করেন দেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের সঙ্গে। কাজ করেন তারেকের সবশেষ চলচ্চিত্র রানওয়ের ক্যামেরাম্যান হিসেবে। সফল ওই চলচ্চিত্রের পর তারেক মাসুদ নতুন ছবির কাজে হাত দিয়েছেন, যার অবধারিত ক্যামেরাম্যান হিসেবেও নির্বাচিত হন মিশুক মুনীর। গতকাল তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ ফিল্ম ক্রুর অন্যরা যান মানিকগঞ্জে সেই চলচ্চিত্রের ভেন্যু নির্বাচনে। ভেন্যু পছন্দ হওয়ার পর তারা যাচ্ছিলেন মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তার কাছ থেকে শুটিংয়ের অনুমতি নিতে।
তারেক মাসুদের বাড়িতে হৃদয়বিদারক চিত্র : শোকাবহ এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার মণিপুরিপাড়া রোডের ১৫২ নম্বর বাসায়। এ বাসারই বাসিন্দা বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ গতকাল সকালে মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তারেক মাসুদের অকাল মৃত্যুর খবর শুনে আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী, অভিনেতা, শুভাকাঙ্ক্ষীসহ শত শত মানুষ এসেছেন তারেক মাসুদের বাসায়। শিল্পীদের মধ্যে রোকেয়া প্রাচীসহ অনেকেই আসেন তার বাড়িতে। কাঁদছে সবাই। এত মানুষের ভিড়েও সান্ত্বনা দেয়ার মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। কে কাকেইবা সান্ত্বনা দেবে, কাঁদছে সবাই।
এটিএন নিউজ পরিবারে শোকের ছায়া : এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অফিসের সবচেয়ে প্রিয় অভিভাবকের মৃত্যুতে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন এটিএন নিউজ পরিবারের সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীরা। দুর্ঘটনার পর থেকেই এটিএন নিউজ পরিবারে নামে শোকের ছায়া। রাত সাড়ে ৮টায় মিশুক মুনীরের লাশ এটিএন কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। এ সময় এটিএন নিউজ কার্যালয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সহকর্মীরা শোক প্রকাশের জন্য গায়ে এঁটেছেন কালো ব্যাজ। কারওয়ানবাজারে হাসান প্লাজার নবম তলায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে যেন চলছে শোকের মাতম। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি কর্মীর চোখেই পানি। সবাই যেন শোকে পাথর হয়ে গেছেন। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। শুধু বোবা কান্না। সবার চোখ শুধু টিভিপর্দায়, যেখানে প্রচার করা হচ্ছে দুর্ঘটনার খবর। একইসঙ্গে উপস্থাপন করা হচ্ছে মিশুক মুনীরের কর্ম।
দুটি তদন্ত কমিটি গঠন : মানিকগঞ্জে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা তদন্তে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের সাতদিনের মধ্যে কমিটিতে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ঢাকা সড়ক সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আরিফুর রহমানকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কামরুল হক এবং মানিকগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ উদ্দীন খান। এছাড়া মানিকগঞ্জের কমিটিতে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকির হোসেন মজুমদারকে প্রধান করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ আলী ভূঁইয়া জানান, ৫ দিনের মধ্যে এ কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।
সড়ক দুর্ঘটনা বেপরোয়া : সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়া সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
এসব ঘটনায় শুধু আমজনতাই নয়, মৃত্যু হচ্ছে বিশিষ্টজনদেরও। মহামারী কিংবা ঘাতক কোনো বিশেষণেই সড়ক দুর্ঘটনাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। দেশের সড়কগুলোয় প্রতিদিন প্রাণহানি ঘটছে বহু মানুষের। দুর্ঘটনায় পড়ে হাত-পা কিংবা শরীরের অন্য কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হচ্ছে হাজারো মানুষ। ৭ মার্চ যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে দেশের বিভিন্ন থানায় পুলিশের দায়ের করা এফআইআরের বরাত দিয়ে জানান, ২০১০ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২ হাজার ৬৪৬ জন। তার মানে প্রতিদিন গড়ে ৭ দশমিক ২৪ জন বা তারও বেশি। এটা সরকারি পরিসংখ্যান। বেসরকারি পরিসংখ্যান বলছে, এই মৃত্যুর হার আরও অনেক বেশি। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় কমপক্ষে ৪ হাজার মানুষ। এসব মৃত্যুর মধ্যে শুধু আমজনতাই নয়, বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও মৃত্যুবরণ করছেন। দেড় বছর আগে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান, মানিকগঞ্জে দুই সচিব, ফেনীতে বিচারপতি আবদুর রউফের স্ত্রী ও পরিবারের কয়েক সদস্যের মৃত্যু হয়েছে।

No comments:

Post a Comment